তুষার আহমেদ — ঢাকা শহরের ব্যস্ততম এক কর্পোরেট অফিসের নির্বাহী। কিছুদিন ধরে অফিসের চাপ, শহরের কোলাহল তাকে হাঁপিয়ে তুলেছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শহর থেকে একটু দূরে বা শহরের বাইরে কিছুটা নির্জন পরিবেশে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবেন। এতে অফিসে আসা যাওয়া একটু কষ্টকর হয়ে যাবে কিন্তু শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

Horror Story Bangla


বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে তুষার সাহেব একটি বাড়ি ভাড়া নিলেন, শহরের সীমানার কাছেই। ভাড়া সস্তা, জায়গা প্রশস্ত। বাড়িটা একসময় একজন বিখ্যাত ঘড়ির কারিগরের ছিল, যার নাম ছিল আব্দুল জব্বার সাহেব।

বাড়িতে সম্ভবত অনেকদিন কেউ থাকেনি তাই পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। ঘরজুড়ে ধুলো জমে থাকা আসবাব, পুরনো বইপত্র, আর দেয়ালে টাঙানো একটা পুরনো কাঠের ঘড়ি।

তুষার প্রথম দিনেই ঘড়িটা দেখে একটু অবাক হয়েছিল। সাধারণ ঘড়ির চেয়ে এটা যেন অদ্ভুত — ঘড়ির কাঁচ ফাটল ধরা, কাঁটার গতি বেশ ধীর।

একদিন রাতের বেলা — ঠিক ৩টার সময়, ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করল। সে ভেবেছিল — হয়ত পুরনো ঘড়ি, যান্ত্রিক সমস্যা হবে। তবে সে ভুল ভেবেছিল।

পরদিন অফিসে গিয়ে সে লক্ষ্য করল — ছোট ছোট স্মৃতি গুলিয়ে যাচ্ছে। লকারের কোড ভুলে গেল, এক সহকর্মীর নাম মনে করতে পারল না।

প্রথম সপ্তাহের শেষে সে বুঝল — প্রতি রাতের পরে তার মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু যেন একটু করে মুছে যাচ্ছে।

 ছোট ছোট জিনিস ভুলে যাওয়া থেকে শুরু করে বড় বড় ভুল হতে লাগল। বন্ধুদের নম্বর, বাসার ঠিকানা, এমনকি তার নিজের বয়স নিয়েও সন্দেহ তৈরি হতে লাগল।

এক রাতে, সাহস করে সে ঘড়ির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

 কিন্তু তখন যা দেখল, তা তার মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত বইয়ে দিল — ঘড়ির কাঁচের ভেতর তার নিজের 

প্রতিবিম্ব নেই। বরং একটা বিকৃত মুখ, যেন পঁচে যাওয়া, গলিত মাংসের মতো ছায়া তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তুষার আতঙ্কে পিছিয়ে গেল। ঘরের দেয়ালগুলো যেন নড়তে লাগল। ঘড়ি থেকে ফিসফিসে গলায় একটি প্রশ্ন এল:

"তুমি কে? মনে আছে?"

পরের দিন, তুষার স্থানীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরনো পত্রিকা ঘেঁটে তথ্য খুঁজতে লাগল।

জানতে পারল —

 ১৯৮৫ সালে, এই বাড়ির মালিক আব্দুল জব্বার সাহেব, যিনি ছিলেন এক বিখ্যাত ঘড়ি নির্মাতা, একসময় "সময়" নিয়ন্ত্রণ করার আশায় গবেষণা শুরু করেন।

 তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশেষ কিছু যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সময়কে উল্টো চালানো সম্ভব — মানুষের স্মৃতি, অতীত এমনকি অস্তিত্বও পরিবর্তন করা সম্ভব।

এক রাতে, তার তৈরি একটি ঘড়ি উল্টোদিকে চলা শুরু করে। সেই রাতের পর জব্বার সাহেব নিখোঁজ হন।

 বাড়ির পরবর্তী বাসিন্দারাও অদ্ভুতভাবে নিখোঁজ হয়েছে বারবার — কেউ স্মৃতি হারিয়ে পাগল, কেউ আত্মহত্যা করেছে।

লোকমুখে শোনা যায়, যে এই ঘড়ির প্রভাবের মধ্যে একবার পড়ে, তার অস্তিত্ব আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। এমনও প্রমাণ পাওয়া গেছে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকা অবস্থায় ঘরের বাসিন্দাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। 

তুষার সিদ্ধান্ত নিল, আর নয়। আজ রাতেই সে এই ঘড়িকে ধ্বংস করবে।

ঠিক রাত ৩টায় একটি হাতুড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘড়ির কাঁটা উল্টোপথে ঘুরতে শুরু করল। ঘরের বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে এলো, যেন সময় জমে যাচ্ছে।

তুষার এগিয়ে গেল। হাতুড়ি তুলতেই তার শরীর জমে যেতে লাগল। অদৃশ্য কোনো শক্তি যেন তার শরীরের ওপর চেপে বসেছে। ঘড়ির কাঁচের মধ্যে সেই বিকৃত ছায়া আবার আবির্ভূত হলো — কিন্তু এবার তার মুখে ঠোঁটের কোণে বিজয়ের হাসি।

"তুমি অনেক দেরি করেছ," ফিসফিস করল সেই ছায়া।

তুষার পুরো শক্তি দিয়ে হাতুড়ি ছুঁড়ে দিল। ঘড়ির কাঁচে চিড় ধরল, কিন্তু সম্পূর্ণ ভাঙল না। বরং ঘড়ির ভেতর থেকে অসংখ্য কাঁটা বেরিয়ে এসে তার হাতকে আঁকড়ে ধরল।

তুষার টের পেল — তার নাম, স্মৃতি, অস্তিত্ব টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

শেষ মুহূর্তে সে কেবল একটা নাম উচ্চারণ করল — "মা..."

 তারপর সমস্ত আলো নিভে গেল।

পরের দিন পরিচারিকা এসে দেখল — ঘরের ভেতর কেউ নেই, মেঝেতে তুষার সাহেবের পরনের কাপড় পড়ে আছে।

ঘড়িটা এখন চুপচাপ রয়েছে। দেয়ালে ঝুলে, যেন কিছুই হয়নি।

 তবে মাঝে মাঝে — বিশেষ করে রাত ৩টায় — আবারও ঘরের ভিতর ফিসফিস শব্দ শোনা যায়:

"তুমি কে...? মনে আছে...?"

অনেক খোঁজা খুঁজির পরও তুষার সাহেবের কুনো অস্তিত্ব পাওয়া গেল না। তাই কিছুদিন পরে বাড়িটা আবার ভাড়া দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো আর দেয়ালের পুরনো কাঠের ঘড়ি —  অপেক্ষা করতে থাকলো তার পরবর্তী শিকারের জন্য।

ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে — ধীরে, নিরবে, উল্টো পথে।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন