পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এক গ্রাম, নাম ঘনছায়া। নামটি শুনেই বোঝা যায়, আলো সেখানে তেমন ঢোকে না। দিনের আলোও যেন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে থাকে। গ্রামের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক দৈত্যের মতো বটগাছ। বটগাছের ঝুরি যেন কারও মরা চুলের মতো ঝুলে থাকে, আর ডালপালা এমনভাবে মেলে আছে যেন কাউকে জাপটে ধরতে চায়। স্থানীয়রা তাকে বলে "ভূতের গাছ"। এই গাছ নিয়েই সাজিয়েছি আজকের ভূতের গল্প।
গাছের নিচে ভূতের কান্না
এই গাছের নিচে রাত হলেই কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। কেউ বলে, বছর পঁচিশ আগে এক বিধবা নারী, ফিরোজা, এই গাছের নিচে আত্মহত্যা করেছিল। তার স্বামী ছিল একজন কাঠুরে, গাছ কাটতে গিয়ে মারা যায়। তারপর থেকেই ফিরোজা একা হয়ে পড়েছিল। ফিরোজা প্রায়ই বট গাছের নিচে একা একা বসে কান্না করতো। গ্রামের লোকজন বলত, তার স্বামীর আত্মা তার উপর ভর করেছে। মানুষ তাকে ডাইনি বলে দূরে সরিয়ে রাখত। আর একদিন হঠাৎ করেই দেখা যায়, সে নিজেই এই গাছের ঝুরি বেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে।
তার মৃত্যুর পর থেকেই রাত হলেই কেউ একজন কান্না করে। প্রথমে কেউ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু একসময় সবাই বুঝে গেল, ব্যাপারটা কেবল বাতাস না, ওটা যেন সত্যি কেউ কাঁদছে, ব্যথায় বা দুঃখে।
এই কাহিনির খোঁজ পায় রকিব হাসান, একজন শহুরে অনলাইন সাংবাদিক, যার বিশেষ আগ্রহ গ্রামীণ লোককাহিনী আর রহস্যের উপর। ঘনছায়া গ্রাম সম্পর্কে প্রথম সে শোনে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে। আগ্রহ বশত সে সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের চোখে সত্যিটা দেখতে হবে।
ভৌতিক গাছের অনুসন্ধানে সাংবাদিক রকিব হাসানের আগমন
রকিব হাসান পৌঁছায় ঘনছায়া গ্রামে। কুয়াশা ঘেরা, নির্জনতা আর গাছের ছায়ায় ঢাকা জায়গাটা যেন কেমন গা ছমছমে। গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে সে এই বট সম্পর্কে জানতে চায়, কিন্তু কেউই এই গাছ নিয়ে কথা বলতে চায় না। সবাই চুপ। কেবল একজন মানুষ, একজন বৃদ্ধ মাসুদ চাচা, একটু আলাপ করল।
রকিব হাসান মাসুদ চাচার কাছে বট গাছ সম্পর্কে জানতে চায়। মাসুদ চাচা, তাকে থামিয়ে ফিসফিস করে বলে, “তুই ভুল করেছিস। গাছ জেগে উঠলে কেউ আর ফিরে আসে না।”
রকিব হাসান হাসে, “ভূত বিশ্বাস করেন চাচা?”
চাচা তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। “ভূত না, আরও খারাপ কিছু।”
চাচা ফিসফিস করে বলে, “সবাই ভাবে ফিরোজা আত্মহত্যা করেছিল… কিন্তু আমি জানি, ওকে মারা হয়েছিল।”
রকিব হাসান চমকে ওঠে। “মানে? কে মারল?”
মাসুদ চাচা তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর নিচু গলায় বলে, “গাছের নিচে কবর আছে একটা...”
– “কবর?”
– “হুঁ। কেউ জানে না। ফিরোজা ছিল ভূতে ধরা একটা মেয়ে। লোকেরা ভয় পেত। গুজব রটে, সে তার স্বামীর আত্মা ধরে রাখে। গ্রামের অনেক লোক ঐ বট গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা একদিন ওকে পিটিয়ে মারে, তারপর গাছে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যার নাটক করে। পরে গাছের গোড়ায় পুঁতে ফেলে।” রকিব হাসানের মনে হল, সে যেন একটি ভূতের গল্প শুনছে।
রকিব হাসান তার গল্পের খোরাক পেয়ে গেছে। সে সিদ্ধান্ত নেয় এক রাত গাছের আশপাশে থাকবে। একটা রেকর্ডার এবং ভিডিও ক্যামেরা সেট করা থাকবে গাছের আশেপাশে।
রাতে ভূতের শোকসংগীত
রকিব হাসান ভিডিও ক্যামেরা সেট করে, রেকর্ডার চালু রাখে।
রাত বাড়ে, শীত নামে। কুয়াশার ভেতর গাছটা যেন আরও বড় হয়ে ওঠে। রাত ১২টা। বাতাস থমথমে, পাখিও নীরব। কেবল মাঝে মাঝে পাতার খসখসানি। হঠাৎ… একটা চাপা কান্নার আওয়াজ। মহিলা কণ্ঠ। যেন কেউ ব্যথায় কুঁকড়ে আছে।
"হুঁ… হুঁহু… হুঁঁ…"
রকিব হাসান ধীরে ধীরে ক্যামেরা চালু করে। গাছের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায়, ঝুরিগুলো অস্বাভাবিকভাবে দুলছে, বাতাস নেই, অথচ কোনো কিছু যেন ওগুলোকে নাড়া দিচ্ছে। সে ভয়ে কেঁপে ওঠে।
রকিব হাসান ক্যামেরা জুম করে গাছের দিকে। হঠাৎই ক্যামেরার স্ক্রিনে ঝাপসা কিছু একটা দেখা যায়। যেন একটা শাড়িপরা অবয়ব… মাথা নিচু, ঝুলন্ত। গাছের ঝুরি থেকে দুলছে।
তারপর একটা মহিলা কণ্ঠ শোনা যায়,
“আমাকে বের করো…”
শব্দটা আসে চারপাশে ছড়িয়ে… যেন বাতাসও কাঁপছে। রকিব হাসান হতবাক। সত্যিই কেউ কিছু বলছে!
“ক… কে?” সে বলে ওঠে।
কণ্ঠটা আবার আসে, এবার আরও করুণভাবে—
“আমাকে গাছের নিচ থেকে বের করো… আমি এখনে শ্বাস নিতে পারি না…”
হঠাৎ মাটির ওপর কিছু একটার নড়াচড়া, যেন কিছু একটা ভেতর থেকে উঠতে চাচ্ছে। ঝুঁকে দেখে একটা হাত! কাদা মাখা, অস্থিরভাবে মাটি ঠেলছে।একটা শুকনো ডাল যেন নিজের ইচ্ছায় সামনে এগিয়ে আসে, রকিব হাসানের পায়ের কাছে। সে পেছনে সরতে গিয়ে হোঁচট খায়।
রকিব হাসান আর থাকতে পারে না, দৌড়ে ফিরে আসে বাড়িতে।
ভূতের রহস্য উদ্ঘাটনঃ মাটির নিচে এক কবর
পরদিন সকালে সে মাসুদ চাচাকে সবটা খুলে বলে। চাচা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুই যদি সত্যি সাহসী হোস, গাছের নিচে একটু খুঁড়। তবে অবশ্যই দিনের বেলা যাবি”।
রকিব হাসান সিদ্ধান্ত নেয়, এইবার সে আসল সত্যি খুঁজে বের করবে। চুপিচুপি ভোরবেলায় সে একটা কোদাল নিয়ে যায় গাছের নিচে।
প্রায় আধাঘণ্টা খোঁড়ার পর, কোদাল ধাক্কা খায় একটা কাঠের কিছুর সঙ্গে। একটা পুরনো, পচা কফিনের অংশ বের হয়ে আসে। রকিব হাসান আরেকটু খুঁড়তেই উঠে আসে একটা কঙ্কালের অংশ, সঙ্গে জড়ানো ছিল সাদা একটা শাড়ির টুকরো। কঙ্কালের মুখে গোঁজা আছে শুকনো কাপড়। যেন জীবিত অবস্থায় চিৎকার বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ কেঁপে ওঠে গাছ। বাতাসে গাছের ঝুরি যেন নাচতে থাকে, এক অদ্ভুত শব্দ হয়, একসাথে কান্না, হাসি আর যন্ত্রণা।
রকিব হাসান ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু সে থামে না। কফিনের চারপাশ পরিষ্কার করে সে দেখে, সেখানে একটা পুরনো লকেটও পড়ে আছে। লকেটের ভেতরে ছবি, একটা পুরুষ আর একটা নারী। হয়তো ফিরোজা আর তার স্বামী।
সে লকেটটা নিজের পকেটে ভরে নেয়, কিন্তু ঠিক তখনই একটা শক্ত কিছু তাকে পেছন থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। সে মাটিতে পড়ে যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই, অথচ গাছের এক শিকড় যেন সরে গেছে… ঠিক যেন কিছু একটা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে
এক মুহূর্তের জন্য রকিব হাসান স্পষ্টভাবে দেখতে পায় - গাছের ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটা শাড়িপরা অবয়ব। মুখ ঢাকা, মাথা নিচু। হাতে মাটির ছোপ লেগে আছে।
কণ্ঠটা আবার শোনা যায়...
“তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছো… এবার আমি মুক্ত…”
ধীরে ধীরে অবয়বটা গাছের গায়ে মিলিয়ে যায়। বাতাস হালকা হয়। ঝুরিগুলো আবার স্থির হয়ে যায়।
সাংবাদিকের প্রতিবেদন ও আতঙ্কের উত্তরসূরি
ঘটনার কয়েকদিন পর রকিব হাসান শহরে ফিরে আসে। ঘটনাটা নিয়ে সে লেখে এক ভয়ানক প্রতিবেদন —“এক বিধবার না-বলা ইতিহাস”। সে ভিডিও এবং অডিওসহ প্রকাশ করে সব প্রমাণ। প্রতিবেদনটা ভাইরাল হয়ে যায়।
তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়।
রকিব হাসান লক্ষ্য করে, যেদিন থেকে সে লকেটটা নিয়ে এসেছে, তার ঘরে মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ শোনা যায়। রাতের নির্জনে আয়নার সামনে এক ঝলক দেখতে পায় শাড়িপরা এক নারী… মাথা নিচু, হাত কাদা মাখা।
শেষ পর্যন্ত, সে লকেটটা নিয়ে গিয়ে নদীতে ফেলে দেয়।
আর তারপর থেকেই — সব নিস্তব্ধ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন