রাজীব ঢাকা শহরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ব্যস্ততার কারণে সে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ পায় না। গ্রামের বাড়িতে অবশ্য কেউ থাকে না, তার বাপ দাদার ভিটায় একটা পুরনো ঘর আছে যেটা সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। তো একবার একসাথে তিন দিনের সরকারি ছুটি পাওয়ায় সে সিদ্ধান্ত নিল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসবে। এই বিষয়টা নিয়েই একটা ভয়ংকর ভূতের গল্প সাজিয়েছি। চলুন গল্পটা শুরু করা যাক।

ভয়ংকর ভূতের গল্প


রাজীবের দাদা-দাদি জীবিত থাকা অবস্থায় প্রায়ই গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো। কিন্তু তার দাদা-দাদির মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়িতে আর খুব একটা যাওয়া হয়নি বললেই চলে। প্রথমদিকে একজন গৃহপরিচারক রাখা হয়েছিল ঘর-বাড়ি দেখে শুনে রাখার জন্য। তার নাম ছিল অরুণ দেব। কিন্তু সে হঠাৎ একদিন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি। তারপর একটি পরিবারকে ঘরটা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। সেই পরিবারের লোকজনও অদ্ভুতভাবে মারা যায়। এরপর থেকে বাড়িটা তালাবদ্ধ আছে। 


বাড়িতে রাজীবের দাদা-দাদির ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র আছে। সেগুলো সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়াই রাজীবের মূল উদ্দেশ্য। সে তার দাদা-দাদির কিছু স্মৃতি সংরক্ষণ করতে চায়। প্রথম দিন থেকেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল সায়নের। দেয়ালে ধুলোমাখা ছবি, সিলিং ফ্যানের ক্রমাগত কাঁপতে থাকা শব্দ, আর রাত হলেই জানালায় বাতাসের ধাক্কা—সব মিলিয়ে যেন কেউ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তার দিকে।


দ্বিতীয় সপ্তাহে সে বাড়ির পড়ার ঘরটা পরিষ্কার করতে গিয়ে খুঁজে পায় একটা পুরনো টিনের বাক্স। অনেকগুলো পুরনো চিঠি, কিছু নোট, আর নিচে ঢাকা দেওয়া ছিল একটা চামড়ার বাঁধাই করা


ডায়েরি। উপরে লেখা—"অনুর জার্নাল"

কৌতূহলে খুলে ফেলে ডায়েরিটা। প্রথম পাতায় বড় অক্ষরে লেখা:

"যদি তুমি আমাকে পড়ো, তাহলে সাবধান থেকো। আমার গল্প এখন শুধু গল্প নয়।"

রাজীবের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু ডায়েরির বাকিটা এতটা আকর্ষণীয় যে থামা যায় না। 

ডায়েরি: ১৯৯৩, মার্চ ২

"আজও বাবার মেজাজ খুব খারাপ। মা কিছু বললেই গালিগালাজ করে, আর মাঝে মাঝে
আমার দিকেও তাকায় একরকম চোখে। আমি জানি, আমি এখানে বন্দী। কিন্তু এই ঘরের
বাইরের জগৎও বুঝি আমার জন্য নয়। তবু লিখি, লিখেই বাঁচি।"


রাজীব পড়ে চলে পাতার পর পাতা। অনু ছিল এক কিশোরী, যার জীবন কেটেছিল এই বাড়িতেই। তার বাবা ছিলেন মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং রাগী। মা ছিল অসহায়। অনুর
লেখার মধ্যে এক ভয়ংকর বিষাদ আর অন্ধকার লুকানো ছিল।


প্রথম কয়েকদিন রাজীবের কিছুই হয়নি। কিন্তু সপ্তম দিন, সে যখন এক পাতায় পড়ে—


"আজ রাতে জানালার বাইরে কে দাঁড়িয়ে ছিল? তার চোখ ছিল রক্তের মতো লাল।
সে আমাকে বলেছিল, অনু আমি তোকে চাই।"



সেই রাতেই রাজীবের ঘরের জানালায় শব্দ হয়। সজোরে বাতাস ধাক্কা দিতে থাকে কাঁচে।
পরদিন সকালে সে লক্ষ্য করে, জানালার বাইরে কাদা মাটিতে মানুষের পায়ের ছাপ।

কিন্তু বাড়ির চারপাশে কেউ ছিল না।

এরপর থেকে ডায়েরির পৃষ্ঠা যেন নিজে নিজেই খুলে যেতে থাকে। একদিন সকালে সে দেখে,

ডায়েরির মাঝখানের একটা পৃষ্ঠা আগে ফাঁকা ছিল, এখন সেখানে লেখা:

"তুই কে? তুই আমার ডায়েরি পড়ছিস কেন?"

রাজীবের হাত কাঁপতে থাকে। এটা যেন এক ভয়ংকর ভূতের গল্প। সে ডায়েরিটা বন্ধ করে বাক্সে লুকিয়ে ফেলে। কিন্তু তাতে কিছুই থামে না। রাতে ঘুমের মধ্যে সে অনুকে স্বপ্ন দেখতে থাকে। একটা গলা—নরম, কিন্তু শীতল—বারবার ফিসফিস করে:

"আমার কথা কেউ জানে না... শুধু তুই জানিস..."

রাজীব চুপচাপ সব সহ্য করতে থাকে। কিন্তু একদিন সে খুঁজে পায় ডায়েরির শেষ দিকে কিছু লেখা, যা আগেও ছিল না।

ডায়েরি: ১৯৯৩, ডিসেম্বর ১২

"আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বাবার ওষুধে বিষ মিশিয়ে দেব। তারপর নিজেও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। আর পারছি না। যদি কেউ এই লেখা পড়ে—জানবে, আমি কেন এই পৃথিবী ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলাম?" 

রাজীবের মাথা চক্কর দিতে থাকে। সে জানত না এই বাড়িতে এমন কিছু ঘটেছিল। সে পৌর অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে—অনুর মৃত্যু হয়েছিল রহস্যজনকভাবে। পুলিশ রিপোর্ট বলেছিল ‘আত্মহত্যা’, কিন্তু গুজব ছিল, অনুর বাবা-ই তাকে মেরে ফেলে পরে নিজেও আত্মহত্যা করে। 

সেদিন রাতে রাজীব ঘুমাতে পারেনি। বাতি জ্বালিয়ে বসেছিল, ডায়েরিটা সামনে রাখা। ঠিক রাত তিনটা নাগাদ সে দেখে—ডায়েরির ওপর ধীরে ধীরে জ্বলন্ত অক্ষরে লেখা হচ্ছে:

"তুই চাইলে আমাকে মুক্তি দিতে পারিস। নিচের ঘরে একবার আয়।"

রাজীব জানত, পুরনো বেসমেন্ট ঘরটা তালা মারা ছিল সবসময়। ভয়ে সে কখনো নামেনি নিচে। কিন্তু এবার এক অজানা শক্তি তাকে টেনে নেয়।

সে তালা ভেঙে নিচের ঘরে নামে।

ভেতরটা ঠান্ডা, ধুলোয় ভরা। এক কোণে ছোট একটা কাঠের খাট, পাশে একটা আয়না। আয়নার উপরে রক্ত দিয়ে লেখা—

"তুই তো জানিস এখন আমার সব গল্প। এবার আমায় বাঁচা।"

এক মুহূর্তে সব বাতি নিভে যায়। রাজীব পড়ে যায় মেঝেতে। হঠাৎ অনুভব করে, পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় এবং সে গর্জে ওঠে—

"কেউ অনুকে পাবে না! ও আমার!"

পরদিন সকাল।

পাড়া-প্রতিবেশীরা দেখে, রাজীব আর বাড়ির দরজা খোলেনি। পুলিশ আসে। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে, রাজীবের দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। মুখে অদ্ভুত এক হাসি। ডায়েরিটা তার বুকের ওপরে রাখা।

সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়, ডায়েরির শেষ পাতায় এখন লেখা—

"আমার সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন একটা নাম "রাজীব"... আমার গল্পের আরেক পৃষ্ঠা।"

রাজীবের মৃত্যুর এক মাস পেরিয়ে গেছে। রিপোর্টে লেখা ছিল "অজ্ঞাত কারণে হৃদরোগে মৃত্যু", কিন্তু তার বোন মধুরিমা জানত, ভাইয়ের কোন হৃদরোগ ছিল না। অন্তত এমনভাবে হঠাৎ মারা যাওয়ার মত অবস্থা ছিল না।

রাজীবের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিতে সে গিয়েছিল সেই পুরনো বাড়িতে—যেখানে তাদের দাদা-দাদি একসময় থাকতেন। উঠোনটা আগাছায় ঢেকে গেছে আর বাড়িটাও কেমন যেন ভূতুড়ে হয়ে গেছে।

বইয়ের তাক ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে খুঁজে পায় সেই চামড়ার বাঁধাই করা ডায়েরিটা।

প্রথম পাতায় লেখা ছিল ঠিক আগের মতো:

"যদি তুমি আমাকে পড়ো, তাহলে সাবধান থেকো। আমার গল্প এখন শুধু গল্প নয়।"

মধুরিমা একটু কৌতূহলী, একটু ভয় পেয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। পাতায় পাতায় অনুর জীবনের কষ্ট, ভয়ের ছায়া, বাবার উন্মত্ততা—সব যেন ধীরে ধীরে তার মনে গেঁথে যেতে থাকে। তার কাছে মনে হয়েছে সে যেন একটা ভয়ংকর ভূতের গল্প পড়ছে।

কিন্তু ডায়েরির এক জায়গায় এসে সে থেমে যায়। যেখানে শেষবার রাজীব থেমেছিল—সেই লাইনগুলো:

"তুই চাইলে আমাকে মুক্তি দিতে পারিস। নিচের ঘরে একবার আয়।"

নিচে ছোট করে আরও একটা লাইন যোগ হয়েছে, যা আগের কপিতে ছিল না:

"তবে আমি কিন্তু একা নই। অরুণ এখনো আমার সাথে আছে।"

মধুরিমা কাঁপতে থাকে। "অরুণ" কে? এই নাম আগে ছিল না। সে বুঝতে পারে, ডায়েরিটা শুধু ডায়েরি নয়—এটা জীবন্ত কিছু।

সে সিদ্ধান্ত নেয়, সত্যিটা জানতেই হবে।

পরদিন রাত।

মধুরিমা নিচে নেমে হাতুড়ি দিয়ে বেসমেন্টের তালা ভাঙে। ভেতরে এখনো সেই আয়না, সেই রক্তমাখা লেখা, শুধু এবার আয়নার ওপরে আরও এক লাইন:

"তুই আমার জায়গায় আসবি?"

হঠাৎ আয়নার কাঁচ কেঁপে ওঠে। মধুরিমা দেখে, নিজের প্রতিবিম্ব নয়—একটা অন্ধকার ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে।

সে ঘুরে তাকায়—কেউ নেই।

কিন্তু তখনই পেছনে কানে ভেসে আসে এক পুরুষ কণ্ঠ:

"অনুকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু ও পালাতে চেয়েছিল। আমি ছাড়িনি। তুই কি পালাতে পারবি?"

ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। মধুরিমা ভয় পেয়ে দৌড়ে নিচের ঘর থেকে উপরে উঠে আসে।

পরদিন সকালে মধুরিমা ডায়েরিতে খুঁজে পায় নতুন কিছু লেখা:

"অরুণ এখনও আমাকে মুক্তি দেয়নি। ও এখন নতুন খেলা শুরু করেছে। রাজীব ছিল প্রথম পৃষ্ঠা। তুই হয়তো দ্বিতীয়।"

মধুরিমা স্থির করে, এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। সে শহরের পুরনো রেকর্ড অফিসে গিয়ে খোঁজ করে "অরুণ" নামে কোনো মানুষের তথ্য মেলে কিনা। পায়—১৯৯০ সালে এই বাড়িতে এক পরিচারক ছিল, নাম অরুণ দেব। তাকে নিয়ে গুজব ছিল, সে জিন-ভূত দ্বারা আক্রান্ত ছিল।

একদিন অরুণ নিখোঁজ হয়ে যায়। অরুণের মৃতদেহ পরে বেসমেন্টে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু তার মৃত্যুর প্রকৃতি ছিল অদ্ভুত। মৃত্যুর পরেও কেউ কেউ বলেছিল—বাড়ির আশেপাশে নাকি তাকে দেখা যায়।

রাতে মধুরিমা আবার ডায়েরিটা খোলে। এবার পুরো ঘরে ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকে, বাতি নিভে যায়। ডায়েরির পৃষ্ঠায় রক্ত দিয়ে লেখা হতে থাকে:

"তুই যদি আমাকে মুক্তি দিতে চাস, তবে আয়নার সামনে দাঁড়া... একবারের জন্য, ভেঙে ফেল এই আয়না..."

ভয়ে জর্জরিত মধুরিমা আবার নিচের ঘরে যায় এবং আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে বলে—"অনু, আমি তোকে মুক্তি দিতে চাই..."

আয়নার ভেতর থেকে অনুর মুখ দেখা যায়—কান্নায় ভেজা, চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে একটা অস্ফুট হাসি।

হঠাৎ অনুর পিছনে অরুণের ছায়ামূর্তি ভেসে উঠলো। এবার মুখ বিকৃত, চোখে আগুন।

সে গর্জে ওঠে—"কেউ অনুকে পাবে না! ও আমার!"

মধুরিমা তার হাতে থাকা মোবাইল ফোন আয়নার দিকে ছুড়ে মারে, আয়নার কাঁচ ফেটে যায়, আর মধুরিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

পরদিন সকাল।

পুলিশ এসে দেখে—মধুরিমা বেসমেন্টে পড়ে আছে, জ্ঞান নেই। তার হাতে ডায়েরি খোলা, শেষ পাতায় লেখা:

"আমি মুক্ত। মধুরিমা আমাকে দেখতে পেয়েছে, মুক্ত করেছে। অরুণ এখন... ডায়েরির ভিতর আটকে গেছে। কিন্তু সাবধান... এই ডায়েরি যেন কখনো খুলা না হয়।"

মধুরিমা বেঁচে যায়, কিন্তু এরপর থেকেই সে কাউকে ডায়েরিটা স্পর্শ করতে দেয় না। বাড়িটি বিক্রি করে দেয়। ডায়েরিটা সে রাখে নিজের কাছে, তালাবদ্ধ এক লোহার সিন্দুকে।

আর মাঝে মাঝে, রাতে ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে—সেই চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি… একটু একটু খুলে যাচ্ছে নিজে থেকেই।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন